ব্রেকিং:
রমজানে সিলেটসহ সারাদেশে নতুন সময়সূচিতে চলছে অফিস সিলেটে স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্সের আত্মহত্যা যুবকের! পবিত্র রমজান মাসের মর্যাদা, ইবাদত ও ফজিলত রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় জৈন্তাপুরে বাজার মনিটরিং চুনারুঘাটে দুর্ঘটনায় চাশ্রমিক-সন্তান নিহত অস্ত্রোপচারে দুর্ঘটনার দায় হাসপাতাল ও চিকিৎসকের: স্বাস্থমন্ত্রী হাইতির প্রধানমন্ত্রী হেনরির পদত্যাগ গত ১৫ বছরে দেশের চেহারা বদলে গেছে : এম এ মান্নান এমপি বিএসএমএমইউ’র নতুন উপাচার্য ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক রমজানের প্রথম তারাবিতে সিলেটে মুসল্লিদের ঢল রমজানে আবহাওয়া যেমন থাকবে সিলেটে?
  • রোববার ১৩ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ২৮ ১৪৩১

  • || ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

সর্বশেষ:
রমজানে সিলেটসহ সারাদেশে নতুন সময়সূচিতে চলছে অফিস সিলেটে স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্সের আত্মহত্যা যুবকের! পবিত্র রমজান মাসের মর্যাদা, ইবাদত ও ফজিলত রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় জৈন্তাপুরে বাজার মনিটরিং চুনারুঘাটে দুর্ঘটনায় চাশ্রমিক-সন্তান নিহত অস্ত্রোপচারে দুর্ঘটনার দায় হাসপাতাল ও চিকিৎসকের: স্বাস্থমন্ত্রী হাইতির প্রধানমন্ত্রী হেনরির পদত্যাগ গত ১৫ বছরে দেশের চেহারা বদলে গেছে : এম এ মান্নান এমপি বিএসএমএমইউ’র নতুন উপাচার্য ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক রমজানের প্রথম তারাবিতে সিলেটে মুসল্লিদের ঢল রমজানে আবহাওয়া যেমন থাকবে সিলেটে?
১৫১৯

ছিকর; ধরিত্রী যখন ক্ষুধা মেটায়

সম্রাট দেব চৌধুরী

প্রকাশিত: ২৩ মার্চ ২০২৪  

সিলেট , প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে সারা বাংলার চেয়েই অনেকটা আলাদা এই সিলেট অঞ্চল। টারশিয়ারী যুগের ভূপ্রকৃতির সাথে এটি বাংলা অঞ্চলের সর্বাধিক বৃষ্টি বিধৌত অঞ্চলও বটে । আর প্রাকৃতিক অনন্যতাই এই অঞ্চলের মানুষের বৈশিষ্ট্য ও জীবন যাপনে ফেলেছে নানা প্রভাব। যে প্রভাব পড়েছে এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্যভ্যাসেও।  আর তাই তো  খাদ্যাভ্যাসে বাকি বাংলার সাথে  সিলেটের যতোটা পার্থক্য দেখা যায় অন্য কোনো অঞ্চলেরই ততোটা  দেখা যায় না । আর আজকের আলোচনা এই সিলেটেরই এক হারিয়ে যেতে বসা খাবার নিয়ে । যেটি পাওয়া যায় না বাংলার অন্য কোথাও।


ছিকর। যারা সিলেটের নন তাদের অনেকের কাছেই নামটা আনকোড়া নতুন। আবার আজকের সিলেটেরও অনেক মানুষই জানেন না কী এই ছিকর, অনেকে আবার নাম শুনেছেন যদিও কিন্তু কখনো সামনাসামনি দেখেননি।

একদম সহজ ভাষায় বললে ছিকর হচ্ছে এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি এক ধরণের পোড়ামাটির বিস্কুট। কিন্তু এই বিস্কুট বানায় কীভাবে ? খায়ই বা কীভাবে ? আদতেই কী খাওয়া যায় মাটির বিস্কুট ? যদি যায় তবে সে বিস্কুট কী বানানো যায় সব মাটি দিয়েই?

ছিকর মূলত সব অঞ্চলের মাটি দিয়ে বানানো যায় না। সিলেট অঞ্চলের পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি টিলার এঁটেল মাটিই ছিলো ছিকড় বানানোর প্রধানতম উপকরণ। । আর এই  ছিকর বানানোর মাটি সংগ্রহ করা হয় পাহাড়ের গভীর তলদেশ থেকে।  সচরাচর সুদীর্ঘ বাঁশের ব্যবহারে সংগ্রহ করা হয় এই মাটি। এটি মুলত এক ধরণের ভেজা ভেজা মিহি মাটি।  তারপরও এটি সংগ্রহ করার পর আরো কয়েক দিন, সারা রাত ধরে ভিজিয়ে রেখে নরম করতে হয়, যাতে ধীরে ধীরে ময়াম বানিয়ে এটিকে আরও মসৃণ করা যায়। এই ময়াম থেকেই তৈরী হয় মন্ড , যে মন্ডকে পছন্দসই আকৃতিতে কেটে বিস্কুটের মতো ছোট ছোট করে টুকরা করা হয়। এ পর্যন্ত এদের বলা হয় কাঁচা ছিকর। এরপর কাঁচা ছিকরগুলো রোদে দু-এক দিন শুকানোর পর চুলায় পুড়িয়ে  এক ধরণের বিশেষ চালুনির ওপর বসানো হয়। তারপর হাঁড়িটি  মাটির গর্তে ঢুকিয়ে ধানের তুষ দিয়ে সেখানে আগুন জ্বালানো হয়। এই ধোঁয়া ধীরে ধীরে ছিকরের গায়ে লাগানো হয়। এটি মূলত ছিকরে বাড়তি সুঘ্রাণ আনার জন্যে করা হয়।  কয়েক ঘন্টা পোড়ালে পরে ছিকর পাংশু বর্ণ ধারণ করে এবং ছিকরে এক ধরনের সুঘ্রাণের সঞ্চার ঘটে।  স্বাদের ভিন্নতার জন্য মাটির মিশ্রণ তৈরির সময় গোলাপজল, আদার রস ও ক্ষেত্র বিশেষে অল্প পরিমান চিনি ইত্যাদি মেশানো হয়।

এই ছিকর এক সময়ে সবচেয়ে বেশি খেতেন মহিলারা। কথায় বলা হতো, মা চাচীদের পছন্দের খাবার হচ্ছে ছিকর। এছাড়াও গর্ভবতী মহিলারা ছিলেন ছিকরের সবচেয়ে বড় ভোক্তা শ্রেণী।
ছিকর খাওয়ানো হতো শিশুদেরও। স্থা্নীয় মানুষের বিশ্বাস ছিলো ছিকড় খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এছাড়াও ১৯৮০-৯০ এর দশকে যখন বাংলাদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সময় পার করছে তখন গ্রামাঞ্চলে অনেক হতদরিদ্র মানুষের ক্ষুধাও মিটিয়েছে ছিকর, যদিও ছিকর সেই অর্থে ক্ষুধা নিবৃত্তির কোন খাদ্য না।

কিন্তু কেনো একটা বিস্তীর্ন অঞ্চলের মানুষ মাটির মতো একটি বস্তুকে খাদ্যে রুপান্তরিত করতে আগ্রহী হলো? কেনো এমন বিচিত্র একটি খাদ্যাভ্যাস দেখা গেলো সারা বাংলার মাঝে কেবল এই সিলেট অঞ্চলেই? এর উত্তরে অনেকেই যদিও বলেন ছিকর মূলত দরিদ্রের ক্ষুধা নিবৃত্তির সহজ সমাধান ছিলো কিন্তু আমাদের এই   আলোচনায় আমরা সেই পথে হাঁটতে পারি না। কারণ ছিকর দরিদ্রের সম্বল ছিলো এমন কোন জোরালো  ঐতিহাসিক চিহ্ন আমরা কখনোই পাইনি , তবে হ্যাঁ সহজলভ্য হওয়ায় নিম্নবিত্তরাও ছিকর প্রচুর পরিমাণে ভোগ করতেন । তবে ছিকরের প্রচলনের নেপথ্যে মূলত খুব সম্ভবত অন্য একটি কারণ ছিলো। মাটি খাওয়ার অভ্যেস মানুষের একেবারে বিরল নয়। এই অভ্যেসকে ইংরেজিতে জিওফেজিয়া বলা হয় । এমন বিচিত্র অভ্যেসের পিছনের কারণটি এই যে, সচরাচর লক্ষ্য করা যায় বিশ্বব্যাপী সে সব অঞ্চলেই মানুষের মাঝে মাটিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহন করার প্রবণতা দেখা যায় যেসব অঞ্চলে মানুষ বিভিন্ন খনিজ উপাদানের অভাব বা লৌহের অভাব শরীরে অনুভব করে থাকেন। আবার গর্ভবতী নারীদের মাঝেও গর্ভাবস্থায় যে বিবিধ অস্বাভাবিক বস্তুকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতা থাকে ( যেমন  চক , পাথরকুচি ইত্যাদি) । মেডিক্যাল সায়েন্স বলে এর পিছনেও মূলত সেসব নারীর শারীরিক কিছু প্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতিই মূখ্য ভূমিকা রাখে। তাই প্রচলিত স্থানীয় বিশ্বাস আর লব্ধ বৈজ্ঞানিক ধারনা থেকে এই অনুমান করাই বরং সঙ্গত যে এক সময়ে সিলেট অঞ্চলে মানুষের মাঝে প্রাকৃতিক খনিজের অভাব ছিলো যা তাদের প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস পূরণ করতে পারছিল না। এছাড়া বিশ্বের অন্যান্য কিছু স্থানে আদিবাসী কিছু গোষ্ঠীকে মাটি খেতে দেখা যায় এই বিশ্বাস থেকে যে এটি তাদের উদরাময় সহ নানা পীড়া সারাবে।  এমনটা হওয়া আসলে অস্বাভাবিকও না কারন প্রাকৃতিক ভাবে সিলেটের মাটি অম্লীয় ধরণের , এছাড়া এ অঞ্চলে একটা দীর্ঘ সময় চাষাবাসযোগ্য জমির অভাব ছিলো যা তৎকালীন সনাতনী কৃষি পদ্ধতিতে চাষ করা কঠিন ছিলো। খুব সম্ভবত এসব সীমাবদ্ধতা আর তার সাথে ভক্ষণযোগ্য বিশেষ ধরণের মাটির সহজলভ্যতাই এ অঞ্চলে এমন অনন্য এক খাদ্যবস্তুর প্রচলন ঘটিয়েছিলো।  

কিন্তু সেদিন আজ অতীত, বিজ্ঞানের আশীর্বাদ আর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ এ অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক কৃষি ব্যবস্থা অত্যন্ত পরিচিত । এছাড়াও সারা বাংলাদেশই আজ একই খাদ্যব্যবস্থায় এসে থিতু হয়েছে। যার ফলাফলে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের স্থানিক বৈচিত্র্যও অনেকাংশেই ম্রিয়মান সব অঞ্চলেই। সিলেট অঞ্চলেও পড়েছে সে ছাপ, যার ফলে ছিকর আজ সিলেটে অত্যন্ত অপ্রচলিত এক খাদ্যবস্তু। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই  এর নাম পর্যন্ত  জানেন না , আর যারা জানেন তাদের অনেকেরও চোখে দেখার সৌভাগ্য হয় না এখন আর।

তবে এখনো কিন্তু খুব সীমিত পরিসরে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার দুয়েকটি স্থানে তৈরী হয় ছিকর।  মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি গ্রামে,হবিগঞ্জ জেলার  নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর সহ কিছু কিছু স্থানে এখনোও অল্প কিছু স্থানীয় মানুষ ছিকর তৈরী করেন । তবে এক সময় যা ছিলো স্থায়ী পেশা এখন তা কেবলই অল্প কিছু বাড়তি আয়ের আর বংশগত চর্চা ধরে রাখার চেষ্টা ব্যতীত আর কিছু না। এখন আর ছিকরেরও নেই নিয়মিত স্থায়ী ক্রেতা । কিছু মানুষের অভ্যাসের অনুষঙ্গ হিসেবে এখন টিকে আছে ছিকর সিলেট অঞ্চলে। খুব সুনির্দিষ্ট কয়েকটি স্থান ছাড়া তাই সারা সিলেটের তেমন কোথাও এখন আর ছিকরের দেখা মিলে না। অথচ এক সময় গ্রামে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে মা , বৌদের কাছে ছিকর বিক্রি করতেন নির্মাতা নারীরা। আজ আর নেই সে সব দিন ।

যদিও ছিকরের আজ আর চাহিদা নেই , এছাড়াও এর  খাদ্যমান নিয়েও আজ প্রশ্ন তোলেন অনেকেই , কিন্তু তবু আজও ছিকর নিজের মাঝে ধারণ করে চলে সিলেটের মানুষের এক নিজস্ব ইতিহাসকে , বয়ে চলে সিলেটিদের এক একান্তই নিজস্ব অভ্যাসকে। যতো দিন ছিকর থাকবে , ততদিন ওই পোড়া মাটির ছিকরের মাঝে তাই বেঁচে থাকবে সিলেটিদের বিগত সময়ের এক সুন্দর স্মৃতিমাখা অভ্যাস।  তাই যে কজন ছিকর নির্মাতা এখনো বর্তমান আছেন আছেন তাদের প্রণোদনা দিতে  যদি আগ্রহী ব্যক্তিরা এগিয়ে আসেন বা সৃজনশীল কেউ যদি নতুন কোনো উদ্যোগ নিতে চান সিলেটের প্রাচীণ এই পণ্যটি নিয়ে তবে তা নিশ্চয়ই প্রশংসনীয় হবে । আর এভাবেই যদি বেঁচে থাকে সিলেটের এই ঐতিহ্য তবে হয়তো আমরাও এর মাঝে আরো কিছু দিন খুঁজতে পারবো আমাদের পূর্বসুরীদের বিগত দিনের সোনালী স্মৃতিগুলোর কিছুটা অংশকে।

লেখকঃ কলামিস্ট ও এক্টিভিস্ট

সিলেট সমাচার
সিলেট সমাচার