ব্রেকিং:
রমজানে সিলেটসহ সারাদেশে নতুন সময়সূচিতে চলছে অফিস সিলেটে স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্সের আত্মহত্যা যুবকের! পবিত্র রমজান মাসের মর্যাদা, ইবাদত ও ফজিলত রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় জৈন্তাপুরে বাজার মনিটরিং চুনারুঘাটে দুর্ঘটনায় চাশ্রমিক-সন্তান নিহত অস্ত্রোপচারে দুর্ঘটনার দায় হাসপাতাল ও চিকিৎসকের: স্বাস্থমন্ত্রী হাইতির প্রধানমন্ত্রী হেনরির পদত্যাগ গত ১৫ বছরে দেশের চেহারা বদলে গেছে : এম এ মান্নান এমপি বিএসএমএমইউ’র নতুন উপাচার্য ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক রমজানের প্রথম তারাবিতে সিলেটে মুসল্লিদের ঢল রমজানে আবহাওয়া যেমন থাকবে সিলেটে?
  • শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
রমজানে সিলেটসহ সারাদেশে নতুন সময়সূচিতে চলছে অফিস সিলেটে স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্সের আত্মহত্যা যুবকের! পবিত্র রমজান মাসের মর্যাদা, ইবাদত ও ফজিলত রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় জৈন্তাপুরে বাজার মনিটরিং চুনারুঘাটে দুর্ঘটনায় চাশ্রমিক-সন্তান নিহত অস্ত্রোপচারে দুর্ঘটনার দায় হাসপাতাল ও চিকিৎসকের: স্বাস্থমন্ত্রী হাইতির প্রধানমন্ত্রী হেনরির পদত্যাগ গত ১৫ বছরে দেশের চেহারা বদলে গেছে : এম এ মান্নান এমপি বিএসএমএমইউ’র নতুন উপাচার্য ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক রমজানের প্রথম তারাবিতে সিলেটে মুসল্লিদের ঢল রমজানে আবহাওয়া যেমন থাকবে সিলেটে?
২৬৫

ফজরে আমি উঠতে পারি না

সিলেট সমাচার

প্রকাশিত: ৬ ডিসেম্বর ২০১৯  

ভোরবেলা ঘুম থেকে জাগতে পারি না আমি। মাঝেমধ্যে জেগে উঠলেও আলসেমিতে পেয়ে বসে। আড়মোড়া ভেঙ্গে আরেকদিকে কাত হয়ে শুয়ে যাই। ফজরের জামাআতে শামিল হতে পারি না। সুবহে সাদিকের সুনির্মল হাওয়া আমার গায়ে ঝিরিঝিরি পরশ বুলানোর সুযোগ পায় না। পবিত্রতার সতেজতম আবহ আমাকে স্পর্শ করে না। বিশুদ্ধ বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার অনুভূতি থেকে আমি বঞ্চিত হই প্রতিদিন।

আরেকটা চমৎকার জিনিস থেকে আমি বঞ্চিত হই। আসলে ‘বঞ্চিত হই’ বলাটা বাঞ্ছনীয় হবে না, আদতে আমি নিজেকে ‘বঞ্চিত করি’। কোন জিনিস থেকে বঞ্চিত হই, সেটা বলছি একটু পরে। তার আগে ছোট্ট একটা গল্পের কথা মনে পড়লো। সত্যি গল্প কিন্তু! আমি খুব ভালো ছাত্র। আমাদের কলেজটাও খুব নাম করা। এই কলেজের একজন কৃতী ছাত্র হলেন আমাদের প্রেসিডেন্ট। অনেক বছর পর তিনি তারুণ্যের স্মৃতিবিজড়িত এই কলেজটাতে এলেন। বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আমি তাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটা মানপত্র পাঠ করেছিলাম।

অনুষ্ঠান শেষে প্রেসিডেন্ট যখন প্রিন্সিপ্যাল স্যারের রুমে, তখন না কি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এত চমৎকার বাচনভঙ্গী আর কাব্যিক উপস্থাপনা ছেলেটার! নাম কী ওর?’ প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন, ‘ও আমাদের একজন মেরিটরিয়াস স্টুডেন্ট- ফাইয়াজ আবদুল্লাহ।’ প্রেসিডেন্ট হেসে বললেন, ‘বাহ! ফাইয়াজ আব্দুল্লাহ- খুব সুন্দর নাম! পড়াশোনা করে কেমন?’ সব স্যার একবাক্যে বললেন, ‘ভেরি পাংচুয়াল অ্যান্ড অ্যাটেন্টিভ।’ ভাইস প্রিন্সিপ্যাল স্যার এই ঘটনা আমাকে পরদিন বললেন। আমি তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! প্রেসিডেন্ট আমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন, এ তো আমার এক জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া! প্রেসিডেন্টের সামনে আমার প্রশংসা করা হবে, স্বপ্নেও কি কখনো ভেবেছিলাম? রোজনামচার খাতায় সেদিনের অনুভূতি লিখে রেখেছিলাম। কালো কালির কলম ছাড়া ইতোপূর্বে অন্য কোনো রঙের কলম দিয়ে আমি রোজনামচা লিখিনি। কিন্তু সেদিনের রোজনামচাতে পাঁচটা রঙিন কলম ব্যবহার করেছি। বাঁধভাঙ্গা খুশির ঢেউ হৃদয়ের সৈকতে উপচে পড়লে যা হয় আর কি!

এটা আমার জীবনের গল্প। আরেকটা গল্প বলি, যে গল্পটা আবু হুরায়রা বলেছেন। তিনি আবার বানিয়ে কোনো গল্প বলতেন না! প্রিয় নবীজি ( ﷺ ) যেভাবে যা বলতেন, তা-ই ঠিক ঠিক আমাদের জন্যে মুখস্থ করে নিতেন। একদিন নবীজি ( ﷺ ) বলছিলেন:

‘তোমাদের মধ্যে একদল ফেরেশতা রাতে এবং আরেকদল ফেরেশতা দিনে আসেন, একের পর এক। ফজর ও আসরের সালাতে তারা মিলিত হন। এরপর যারা তোমাদের মধ্যে ছিলেন, তারা উঠে যান। এবার তাদের রব তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, যদিও তিনি তাদের অবস্থা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানেন, ‘আমার বান্দাহদের কোন অবস্থায় রেখে এসেছো? তারা বলেন: আমরা তাদের কাছ থেকে যখন চলে আসছিলাম, তখন তারা সালাতে মগ্ন ছিলো। আবার যখন তাদের কাছে এলাম, তখনও তারা সালাত আদায়রত অবস্থায় ছিলো।’

এই গল্পটা ইমাম বুখারী তার হাদিসের গ্রন্থে এনেছেন। বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিমও। বোঝা-ই যায়, এই গল্পের বিশুদ্ধতা সন্দেহাতীত!

আমি ভাবছি ভিন্ন কথা। প্রেসিডেন্টের সামনে সেই যে এক বছর আগে আমার প্রশংসা করা হয়েছিলো, তাতে আমি কেমন উদ্বেল হয়েছিলাম! আচ্ছা, সাময়িক আত্মতৃপ্তি ছাড়া সেই আনন্দানুভূতির আর কোনো আবেদন কি এখন অবশিষ্ট আছে? নেই! কিংবা প্রেসিডেন্টের কি মনে আছে আমার কথা? নেই!

অন্যদিকে… আল্লাহ কি ভুলে যান কোনোকিছু? না। আল্লাহর কাছে পেশ করা কোনো রিপোর্ট কি বৃথা যায়? না।

সেই মানুষগুলো কত না ভাগ্যবান, যাদের নামে ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে প্রশংসা করেন! সেই আলোকিত মুখগুলো কত না সফল, মাসজিদের সাথে যাদের হৃদয় জড়িয়ে থাকে ভালোবাসার বন্ধনে! সেই বন্ধনের সুতো ফেরেশতারা টেনে নিয়ে যান আরশ পর্যন্ত! কেমন সৌভাগ্যবান তারা!

আমারও তো সুযোগ ছিলো, এদের কাতারে নিজেকে শামিল করার। আসরের সালাত তো আমিও আদায় করেছিলাম! মাগরিব সালাতটাও মিস হয়নি, যদিও তাড়াহুড়ো করে গিয়েছি। দুই রাকাত মাসবুক না হয় হল, ‘ইশা-ও তো আদায় করে এলাম। আলসেমি না করে ফজরটাও যদি আদায় করতাম, তাহলে আমিও আমার প্রিয়তম প্রভূর সামনে প্রশংসিত হতাম।

আমি আরো ভাবি… এই যে মুয়াজ্জিনের প্রাণস্পর্শী আহ্বান আমাকে প্রাণিত করছে না, ফজরটা হেলায় পার করে দিচ্ছি, এর কারণে শুধু আল্লাহর সামনে প্রশংসিত হওয়া থেকেই যে বঞ্চিত হচ্ছি, তা নয়। এই অবহেলার দরুণ আল্লাহর জিম্মা থেকেও আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছি। আমার দিনগুলো যে অস্থিরতায় কাটে, সময়গুলো বিবর্ণ-ধূসর হয় হররোজ, এর কারণ কি তাহলে এটাই? আল্লাহর তত্ত্বাবধান যদি আমার ওপর না থাকে, জীবনটা নির্ভার হবে কীভাবে? প্রিয় নবীজি ( ﷺ ) তো বহু আগেই আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন:

‘যে ফজরের সালাত আদায় করলো, সে আল্লাহর তত্ত্বাবধানে চলে এলো। আল্লাহ যেন নিজ তত্ত্বাবধানের কোন কিছু সম্পর্কে তোমাদের বিরুদ্ধে বাদী না হন। কারণ তিনি যার বিরুদ্ধে আপন তত্ত্বাবধানের কোনো কিছু সম্পর্কে বাদী হবেন, তাকে পাকড়াও করবেন, এরপর তাকে উপুড় করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন। [সাহীহ মুসলিম]

এই হাদিস আমার ভাবনার জগৎটাই এলোমেলো করে দিচ্ছে। কী মোহগ্রস্ততায় আমি নিজেকে নিজে ঠেলে দিচ্ছি অনিশ্চিত অন্ধকারে, জানি না। বিছানার মোলায়েম স্পর্শে সালাতকে ভুলে থেকে আগুনের নির্মম স্পর্শের জন্যে কেন নিজেকে প্রস্তুত করছি তিল তিল করে, জানি না। শুধু জানি, এই আত্মবিধ্বংসী অভ্যাস থেকে আমাকে মুক্ত হতে হবে। হতেই হবে।

এই হাদিস আমার ভেতর আরেকটা উপলব্ধির জন্ম দিয়েছে। আমার অস্থিরতাপূর্ণ আটপৌরে জীবন, বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার পর শুরু হওয়া উদয়াস্ত ব্যস্ততা, যেখানে আসমানী মদদের ছিঁটেফোঁটা নেই, সেই জীবনটাকে আল্লাহর কাছে সমর্পিত করতে পারলে আরেকটু কি গোছানো হতো? আরেকটু নির্ভার হতো? মনে হয় হতো। বিশ্বাসী অন্তর আমাকে কেন জানি প্রণোদনা দিচ্ছে এদিকে। এই সমর্পণের চমৎকার একটি সিঁড়ি হল ফজরের সালাত। তাহলে কেন এই সুযোগ হাতছাড়া করবো আমি?

আমার মানসিক যন্ত্রণা আরো বহুগুণ বেড়ে গেলো, যখন জানতে পারলাম, আমাকে প্রচণ্ডভাবে নিন্দা করা হয়েছে কুরআনের পাতায়। আমি উৎসুক হয়ে আয়াতটা খুলে পড়তে লাগলাম:

‘এদের পরে এমনসব মন্দলোকেরা স্থলাভিষিক্ত হল, যারা সালাত নষ্ট করলো এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো। এরা শিগগির ‘গাই’ (জাহান্নামের একটি উপত্যকা) এর মুখোমুখি হবে।‘ [সুরা মারিয়াম: ৫৯]

কারা সেই হতভাগ্য, যাদেরকে আল্লাহ নিজেই ‘মন্দ’ বলছেন! এরা তারাই, যারা আমার মতো সালাতে হেলা করে। বলতে দ্বিধা নেই, চিন্তাভাবনা করে দেখলাম, আমি সেই মন্দলোকদেরই একজন হয়ে যাচ্ছি। আমি সালাতকে অযত্ন করছি। নিজের খেয়াল-খুশি মতো ঘুমিয়ে থাকছি, আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর চেয়ে আয়েশী ঘুমের স্বাদ আস্বাদনে প্রবৃত্ত হচ্ছি। জাহান্নামের উপত্যকাই কি তবে আমার শেষ ঠিকানা?

আমি কি এতটাই নীচ? আমি কি এতটাই হীন? হ্যাঁ, আমি এতটাই নীচ ও হীন যে, আমার কানে এমনকি নির্গত হয় শাইত্বানের মূত্র। খতীব সাহেবের মুখে অনেকবার এ কথাটা শুনেছি, কিন্তু কথাটা খুব হালকা বলে মনে হতো। বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ হতো। যখন আল্লাহর রাসূলের ( ﷺ ) কাছ থেকেই শুনলাম, তখন কি আর সংশয়ের সুযোগ থাকে?

আমাদের গল্পটা শোনাচ্ছেন ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ (রা.)-

‘রাসূলুল্লাহর ( ﷺ ) কাছে এক ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা হোল। বলা হল: ভোর হওয়া পর্যন্ত সে ঘুমিয়ে ছিলো, সালাতে দাঁড়ায়নি। রাসূলুল্লাহ ( ﷺ ) বললেন: সে এমন লোক, শাইত্বান যার কানে প্রশ্রাব করেছে।’ [বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ ও ইবন হিব্বান]

এই যে শাইত্বানের প্রস্রাব করে দেয়া, এটার অর্থ হল, শাইত্বান আমার উপর জয়ী হয়েছে। আমি যে তার অনুগত ও বশ্য, সেই সত্যের স্মারক হল, তার এই প্রশ্রাব করে দেয়া। ছোটলোকের ছোটলোকি কারবার আর কি! কিন্তু আমার সাথে কেন এই ছোটলোকির সুযোগ সে পেলো? কারণ আমিও তার কথা মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তার মতই নীচ হয়ে গেছি।

ছিঃ, এ কেমন আমি?

এখানেই শেষ নয়। দুনিয়ায় যতো ভর্ৎসনা-প্রকাশক শব্দ আছে, এর মধ্যে জঘন্যতম অভিব্যক্তির একটা তালিকা যদি করা হয়, তাহলে নিশ্চিত ‘মুনাফিক’ শব্দটা প্রথমদিকেই থাকবে। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করার চিন্তা করি, কেউ যদি আমাকে ‘মুনাফিক কোথাকার!’ বলে, আমার কেমন অনুভূতি হয়! অথবা আমি যদি কাউকে ‘মুনাফিক’ বলে সম্বোধন করি, তাহলে কী বিপুল তেজ ও ক্রোধ নিয়ে সে আমার দিকে তেড়ে আসবে? এর কারণ কী? কারণ হোল, মুনাফিকি একটি ঘৃণিত চরিত্র, গর্ব করার মতো কোনো বিষয় নয়।

কিন্তু… এই ‘মুনাফিক’ অভিধার তিলক যদি আমি নিজেই আমার কপালে পরে নেই, তাহলে কার কী করার আছে? আবারো আবু হুরায়রার কাছে যাই। তিনি আমাদেরকে শোনাচ্ছেন আল্লাহর রাসূলের ( ﷺ ) একটা উক্তি:

‘ফজর ও ইশার চেয়ে মুনাফিকের জন্যে কঠিন কোনো সালাত নেই।‘ [বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবন মাজাহ]

আমি মুনাফিক নই ঠিক, কিন্তু মুনাফিকের মতো কাজই তো করলাম ফজর ত্যাগ করার মধ্য দিয়ে। হায়, দিন দিন কত নিচে নেমে যাচ্ছি! কত নীচ হয়ে যাচ্ছি! আমি নিজেকে বলি, উপুড় হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবার মতো পাপিষ্ঠ তাহলে আমি? শাইত্বানের স্রাব প্রস্রবণের স্থান হবার মতো নীচ কি আমি? মুনাফিকের মতো ঘৃণিত অভিধায় অভিহিত হবার মত কি অধম আমি? আল্লাহর কাছ থেকে নিন্দিত হবার মতো হতভাগা হয়ে উঠার কথা কি আমার ছিলো? ছিলো না।

আমি এই নীচতা থেকে পরিত্রাণ চাই। আমি এই হীনতা থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে চাই। শাইত্বানের অনুগামী হওয়ার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে চাই। আমি আমার প্রিয়তম প্রভূর কাছে প্রশংসিত হতে চাই।

সিদ্ধান্ত নেই, ফজর সালাত ত্যাগ করবো না কখনোই। ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু আযানের পর আবারো তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। নবীজির ( ﷺ ) সাহাবী সামুরাহ ইবন জুনদুব (রা)-কে স্বপ্নে দেখি। তিনি আমার পাশে এসে বসলেন। মাথায় হাত রাখলেন। তারপর বললেন, ‘তোমাকে স্বপ্নের মধ্যেই একটা স্বপ্নের গল্প বলি’। আমি তো গল্প পছন্দ করি খুব। সোৎসাহে বললাম, ‘বলুন না প্লিজ!’ তিনি গল্প শুরু করার আগে বললেন, ‘এই যে স্বপ্নটা, এটা কিন্তু যেনতেন স্বপ্ন নয়। তোমাকে যে স্বপ্নের গল্প করছি, এটা নবীজি ( ﷺ ) দেখেছিলেন!’ আমি আরো উৎসুক হলাম। তিনি গল্পটা শোনাতে লাগলেন। যখনই বললেন:

‘যে ব্যক্তির মাথা পাথর দিয়ে চূর্ণ করে দেয়া হচ্ছিলো, সে হচ্ছে এমন ব্যক্তি, যে কুরআনকে নেয় ও প্রত্যাখ্যান করে এবং ফরয সালাত রেখে ঘুমিয়ে থাকে।’ [সাহীহ বুখারী]

আমি প্রচণ্ডভাবে ঘেমে যাচ্ছিলাম। ধড়পড় করে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। ততক্ষণে ফজরের সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাড়াহুড়ো করে দুই রাকাত ফরয আদায় করে নিলাম। কিন্তু মনটা কেমন উদাস হয়ে থাকলো। কিছুতেই স্থির হতে পারছিলাম না। কিসের যেন শূন্যতাবোধ আমাকে গ্রাস করছিলো। একে তো জামাআতের সাথে পড়িনি; আবার দুই রাকাত সুন্নাতও বাদ দিয়েছি। এই দুই রাকাত সুন্নাতের ব্যাপারে আমাদের নবীজি ( ﷺ ) বলেছিলেন:

‘পৃথিবী এবং পৃথিবীর মধ্যবর্তী যা কিছু আছে, তারচেয়ে বেশি উত্তম ফজরের দুই রাকাত (সুন্নাত) সালাত।’ [মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, আহমাদ]

জায়নামাযে বসে বসে আরেকটা ভাবনার সৃষ্টি হোল। আচ্ছা, ফজরের দুই রাকাত সুন্নাতের মূল্য যদি এত বেশি হয়ে থাকে, তাহলে ফরজ দুই রাকাতের মূল্য ও মর্যাদা কত বেশি হতে পারে! আধা ঘণ্টা বেশি ঘুমানোর জন্যে আমি প্রতিদিন এত বড়ো সম্মান ও মর্যাদাকর উপলক্ষকে হাতছাড়া করে চলছি! কী বোকা আমি! আমাকে কি আমি ধিক্কার দেবো? না, তা দিয়ে লাভ নেই। বরং আর দেরি না করে সৌভাগ্যবানদের কাতারে নিজেকে শামিল করে ফেলতে স্থিতধী হয়ে যাই।

এরপর থেকে আমি ফজরের সালাতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করি। বিছানার পেলবতা আমাকে আর পুরনো গর্তে ফেলতে পারে না। ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম’ আমার কানে অপার্থিব সুরের মূর্ছনা নিয়ে আসে। কী এক তন্ময়তার ঘোর আমাকে পেয়ে বসে! আমি ধীর পদক্ষেপে মাসজিদের দিকে পা বাড়াই। পৃথিবীর কোল থেকে রাত্রি তখনো পুরোপুরি নামে নি। আবছা অন্ধকারের বুক চিরে আমার কদম অগ্রসর হয়। কেমন একটা তৃপ্তির রেশ আমার ‘সুপ্তি-মগন’কে আলতো ছোঁয়ায় জাগাতে থাকে। এই তৃপ্তিবোধের উৎস কোথায়? উৎস তো অনেক! তোমাকে কোনটা বলি? একটা উৎস হতে পারে এই হাদিস:

‘জামাআত সহকারে যে ইশা আদায় করলো, সে যেনো অর্ধরাত্রি ধরে (নফল) সালাত আদায় করলো এবং জামাআত সহকারে যে ফজর আদায় করলো, সে যেনো সারারাত ধরে (নফল) সালাত আদায় করলো।’ [সাহীহ মুসলিম, মুসনাদ আহমাদ]

গতরাতে জামাআতের সাথে ইশার সালাত আদায় করেছিলাম, আলহামদুলিল্লাহ। ফজরটাও জামাআতের সাথে আদায় করতে যাচ্ছি। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার হিসেবের খাতায় সারা রাত নফল সালাত আদায়ের সাওয়াব যোগ হতে যাচ্ছে, আমি তৃপ্ত হবো না তো কে হবে? শাইত্বান এতদিন আমার সাওয়াবের নদীতে রুক্ষ বালুচরের উন্মেষ ঘটিয়েছে, আর আজকে আমি তার বালুচরে বিশ্বাসের ঢেউ নিয়ে আসতে পেরেছি, আমি উদ্বেল হবো না তো কে হবে?

এই তৃপ্তিবোধের ঘুড়ির নাটাই আরো কয়েক জায়গায় আছে। এই যেমন এই হাদিসটা খুব চমৎকার! এটাকে যদি আক্ষরিক অনুবাদ করা হয়, তাহলে অর্থ দাঁড়াই এই: ‘যে ব্যক্তি দুইটি শীতল সালাত আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ [বুখারী, মুসলিম, ইবন হিব্বান, দারেমী, আহমাদ]

‘দুইটি শীতল সালাত’ বলতে এখানে কী বোঝানো হয়েছে, সে ব্যাপারে সকল স্কলার একমত: আসর সালাত ও ফজর সালাত। এই দুই ওয়াক্তে প্রকৃতি তুলনামূলক স্নিগ্ধ ও শীতল থাকে।

এই হাদিসের স্নিগ্ধতা যখন আমাকে স্পর্শ করে, হাদিসের মর্মবাণী যখন আমার মর্মমূলে শীতলতার অঙ্কুরোদগম ঘটিয়ে চলে, তখন আমার মতো প্রশান্ত, আমার মতো নির্ভার আর কেউ থাকে না। এরকম আরেকটা ছোট্ট হাদিস আছে, আমার চোখেমুখে প্রশান্তির ঝিকিমিকি এনে দেয়: ‘এমন কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবে না কখনো, যে সূর্য ওঠার আগে এবং সূর্য ডোবার আগে সালাত আদায় করে।’ [মুসলিম, নাসাঈ, তাবারানী, ইবন হিব্বান, ইবন খুযাইমাহ]

এতদিন নিজেকে নিয়ে যে হীনমন্যতার ডালপালা বেরোতে শুরু করেছিলো মনের বৃক্ষে, এই হাদিসগুলো যেন সেগুলো ছেঁটে দিয়ে আবারো দৃষ্টিনন্দন একটা বৃক্ষ দাঁড় করিয়েছে আমার ভেতর, যে বৃক্ষের ছায়ায় আমার ক্লান্ত বদন দখিনা হাওয়ার পরশ মাখে, যার শাখা-প্রশাখায় ফিরদাউসের পাখিরা এসে গান ধরে। আমি শুনি আর আন্দোলিত হই। আমি দেখি আর আলোড়িত হই।

তবে এতটুকু পথ মাড়িয়ে এসে প্রশান্তির জায়গাটা নিজের করে নিতে মোটেও যে বেগ পোহাতে হয় নি, তা কিন্তু নয়। আমাকে কতকিছু পিছুটান হয়ে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে! যখন শাইত্বান দেখলো, আমাকে কোনোভাবেই ফজর থেকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না, তখন রাতের বেলা আমার জন্যে হরেক পদের ব্যস্ততার ডালি নিয়ে এসে হাজির হোল। উদ্দেশ্য- আমি যেন অনেক রাত করে ঘুমাই, আর ফজরে কোনরকম যদি উঠিও, পূর্ণ মনোনিবেশের সাথে যেন ফজর আদায় না করতে পারি। আমি তার এই ফন্দি প্রথমে না বুঝে অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছি। ভাবলাম, অ্যালার্ম ক্লক আছে, আমিও আল্লাহর উপর ভরসা রাখি, মাসজিদও কাছে বিধায় আযান কাছ থেকে শোনা যায়, অতএব জাগ্রত হওয়া নিয়ে আমার তো কোনো দুশ্চিন্তা নেই। আসলেই জাগ্রত হওয়া নিয়ে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ক্ষতি যে জায়গায় হয়ে গেলো, সেটা হোল, আমি পূর্ণ হক আদায় করে ফজরে শামিল হতে পারছিলাম না। সালাতে দাঁড়ালে চোখের পাতা লেগে আসতে চায়, ইমামের কিরাআত মনোযোগ দিয়ে শোনার ধৈর্য ক্রমশ কমে আসে, কোনরকম সালাত শেষ করে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচি! কিন্তু শাইত্বান আর কতদিন পার পাবে? চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন। আমি ঠিকই হাতেনাতে ধরে ফেললাম তার ফন্দি। আমাকে কুরআন স্মরণ করিয়ে দিলো:

‘আর তারা যখন সালাতে দাঁড়ায়, তখন আলসেমির সাথে দাঁড়ায়।’ [সূরা আন-নিসা: ১৪২]

আরে সব্বনাশ! এই রুকূর আয়াতগুলো তো মুনাফিকদের চরিত্র বর্ণনায় অবতীর্ণ হয়েছে! তবে কি আমিও তাদের একজন হয়ে যাচ্ছি? এদ্দিন তো তাদের কাতারে ছিলাম ফজর ত্যাগ করার মাধ্যমে। এখন দেখছি ফজর আদায় করেও তাদের একজন হয়ে যাচ্ছি! কারণটা কী? কারণটা আর কিছু নয়, আমি পূর্ণ মনোনিবেশ ও যথাযথ আন্তরিকতা নিয়ে সালাতে দাঁড়াচ্ছি না।

কিন্তু এই অভ্যাস ছাড়তেও দেরি হতে লাগলো। আজ নয় আগামীকাল, এই তো কালকে থেকেই ছাড়বো… এভাবে করতে করতে আমার আর রাত জাগা বন্ধ হচ্ছিলো না। এই চিন্তার আলস্যকে এক ঘা দিয়ে বিদায় না করতে পারলে সমূহ বিপদ! আল্লাহর রাসূলের সাহাবী কাব ইবন মালিক (র) এভাবেই তো পিছিয়ে পড়েছিলেন একবার! তাবুক যুদ্ধে সৈন্যবাহিনীর সাথে তিনি বের হননি। দেরি করছিলেন। এখন নয়, একটু পরে। আজকে নয়, কালকে। সৈন্যবাহিনী তো ধীরগতিতেই আগাচ্ছে, আর আমি তাগড়া যুবক, সঙ্গে আছে তেজী ঘোড়া, কাজেই, যখনই বের হই, আমি তাদের সাথে মিলিত হবো। তারপর কী হোল? একদিন গেলো, দুইদিন, তিনদিন, চারদিন… সৈন্যবাহিনী অনেক দূরে চলে গেলো, তারও আর যুদ্ধে যাওয়া হোল না। ফলাফল? আল্লাহ ও তার রাসূলের ( ﷺ ) অসন্তুষ্টি। এই ঘটনা আমাকে তাড়না দিতে লাগলো, ‘যা করার আজ থেকেই শুরু কর! কালকে করবো বলে দেরি করার অর্থই হচ্ছে অনিশ্চয়তার দিকে নিজেকে ঠেলে দেয়া।’

তারপর থেকে আমি ডিটারমাইন্ড। সেদিন থেকেই আর কখনো অধিক রাত পর্যন্ত জাগি না। ছোটবেলায় ইশকুলে পড়া ‘আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ / মেইক অ্যা মেন হেলদি অ্যান্ড ওয়াইজ’ ছড়া খুব মনে পড়তে থাকে। পরিমিত ঘুম যাতে হয়, এমন সময় হিসেব করে ঘুমিয়ে যাই। আয়াতুল কুরসী তো মায়ের কোল থেকেই পাঠ করে আসছি, এখনো বাদ যায় না। সূরা ফালাক্ব আর নাস পড়ে, হাত দিয়ে গায়ে পরশ বুলিয়ে ডান কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি আল্লাহর নামে। মুয়াজ্জিনের আযানের সাথে সাথে আবার জেগে উঠি। ধীরেসুস্থে অযু করি। সময় থাকলে দুই রাকাত সুন্নাত বাসা থেকেই আদায় করে মাসজিদের উদ্দেশে রওনা হই। খোলা বাতাসে আমার কণ্ঠ খলখল করে ওঠে। মায়ের কাছে শেখা সুরাগুলো বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকি। পবিত্রতার আবেশ জড়ানো অনুভূতি আর জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার আনন্দ মিলে আমার ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। নিজের অর্জিত পাপগুলোর কথা ভেবে চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে কখনো কখনো। তবুও ভরসা পাই, এমন জায়গায় নিজেকে সমর্পণ করতে যাচ্ছি, শত অপরাধ সত্ত্বেও যিনি বান্দাহকে কাছে টেনে নেন। ভোরের পাখিগুলো ঘুমের পাড়া জাগাতে শুরু করে। কখনো মনে হয়, আমার খলখল করা কণ্ঠের সাথে ওরাও একাত্ম হতে চাইছে। গলির মোড়ে ইলেক্ট্রিকের খাম্বায় দুইটা শালিক-সদৃশ পাখি হঠাৎ নজরে পড়ে। আমি ওদের দিকে তাকাই, আমার বন্ধু নজীবের ছড়াটা মনের ভেতর নতুন কোনো দ্যোতনার সৃষ্টি করে:

‘বুকের খাতায় খুব যতনে / একটা স্বপন আঁকি
ফিরদাউসের ফুল বাগানে / আমি হবো পাখি।’

আমি পথ চলতে থাকি। মাসজিদের কাছে এসে পথ শেষ হয়। ভুল দেখছো, এই পথের শেষ এখানে নয়। এই পথ ফিরদাউসের স্বর্ণালী তোরণদ্বার পর্যন্ত প্রলম্বিত। আমি সেই পথেই হাঁটছি। তুমি যাবে আমার সাথে?

সিলেট সমাচার
সিলেট সমাচার